গুপ্তিল জাতক -(Guptil Jatak)-আলপনা বসু-Alpana Basu
গুপ্তিল জাতকঃ—
জাতক, বুদ্ধের পূর্ব জন্মের স্মৃতিচারনের মধ্য দিয়ে শ্রাবককূলকে নীতিশিক্ষা প্রদানের এক অভূতপূর্ব ধারা। শাস্তা, বিভিন্ন সময়ে,পরিস্থিতির বিচারে পূর্ব জন্মের আখ্যান শুনিয়ে তাঁর অনুসারীদের মার্গ দর্শন করিয়েছেন,যা এক কথায় অনবদ্য। জাতক একটি মহাকাব্য। পৃথিবীর সমস্ত ছোটগল্পের উৎস এই জাতক। পালি ভাষায় “ জাতকত্থ বন্ননা” নামে লেখা হয়েছে। বোধিসত্ত্ব হিসাবে বুদ্ধ ৫৫০ বার জন্ম গ্রহন করেছিলেন, দান করেছেন বিস্তর, এমন কি নিজের প্রান দিয়েও অন্যের জীবন রক্ষা করেছেন। এই ধরনের বহু কাহিনী জাতকে বর্নিত। আজ দানের মহিমার উপর একটি জাতক কাহিনী বর্ননা করবো।
পুরাকালে বারানসীতে রাজা ব্রহ্মদত্তের সময় বোধিসত্ব এক গন্ধর্ব কুলে জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁর নাম ছিলো গুপ্তিল। গন্ধর্ব বিদ্যায় তাঁর সমকক্ষ সমগ্র জম্বুদ্বীপে আর কেউ ছিলো না। তিনি অবিবাহিত থেকে নিজের অন্ধ মাতাপিতার সেবায় জীবন অতিবাহিত করছিলেন।
বারানসীর কিছু বনিক বানিজ্যের জন্য কোন এক সময় উজ্জয়নী নগরে গিয়েছিলেন। সেখানে এক বিশেষ উপলক্ষে উৎসব হবে জানতে পেরে, কার্য শেষে নিজেদের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ করে মালা, গন্ধদ্রব্য লেপন করে,খাদ্যবস্তু ক্রয় করে উৎসব প্রাঙ্গনে উপস্হিত হন এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে একজন গন্ধর্ব কে আনয়নের আজ্ঞা দেন। সেই সময় মুসিল নামে এক গন্ধর্ব বীনাবাদক হিসাবে উজ্জয়ণীতে বিখ্যাত ছিলেন। বনিকরা তাকেই নিজেদের গন্ধর্ব নিযুক্ত করেন।
সঙ্গীতের তিন ধাপ হলো উদারা, মুদারা আর তারা। মুসিল তারার স্তরে সুর তুলে বীনা বদান শুরু করলেন। কিন্তু বারানসীর বনিকেরা ইতিপূর্বে গুপ্তিল গন্ধর্বের বীনা বাদন শ্রবন করেছেন, তাই মুসিলের বীনার ঝংকার তাদের কর্ণদ্বয়কে পীড়ন করতে লাগলো। মনে হতে লাগলো কেউ যেন মাদুরের উপর আঁচড় কাটছে। মুসিল বুঝতে পারলেন যে কেউ তার বীনা বাদনে খুশী নয়। তখন তিনি বীনা মধ্যম লয়ে বাজাতে শুরু করলেন। কিন্তু বনিকেরা তাতেও সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন না। তখন মুসিল ভাবলেন, এই মূর্খেরা কেউ সঙ্গীতের সমঝদার নয়। তখন পুনরায় তিনি বীনার তার গুলো আরও শিথিল করে বাজাতে লাগলেন, তাতেও শ্রোতারা ভাল-মন্দের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন না দেখে, মুসিল বনিকদের প্রশ্ন করলেন যে, তারা কি কারনে বীনা বাদনে সন্তোষ লাভ করছেন না। তখন পরিহাস ছলে বনিকেরা তাকে বললেন যে তিনি এতক্ষন বীনা বাজাছিলেন সেটাই তারা বুঝতে পারেন নি, ভেবেছিলেন তিনি বীনার সুর বাঁধছিলেন। প্রশ্নোত্তরে মুসিল জানতে চান তারা কি আর কোন উচ্চস্তরের বীনাবাদককে জানেন, না, না কি নিজেদের রসবোধের অভাবে সন্তোষলাভ করতে পারছেন না। একথা শুনে, বনিকেরা তাকে জানালেন, যারা বারানসীর গুপ্তিল গন্ধর্বের বীনাবাদন শুনেছেন তাদের কাছে আপনার বাজনা নেহাতই মায়েদের কাছে ছেলে ভোলানোর গান ছাড়া আর কিছু নয়। একথা শোনার পর মুসিল তার পারিশ্রমিক ফিরিয়ে দিতে চাইলেন এবং বনিকদের কাছে অনুরোধ করলেন, তারা যখন বারানসী প্রত্যাবর্তন করবেন তখন যেন তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। তিনি গুপ্তিলের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। বনিকেরা বারানসী প্রতিগমনের সময়, তাকেও নিয়ে গেলেন এবং গুপ্তিলের বাসস্থান দেখিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রস্হান করলেন।
মুসিল গুপ্তিল গন্ধর্বের গৃহে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন গুপ্তিলের বীণাটি এক স্হানে বাঁধা রয়েছে।আশপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন তিনি বীণাটি খুলে বাজাতে আরম্ভ করলেন। গুপ্তিলের অন্ধ পিতামাতা ভাবলেন ইঁদুর বুঝি বীণার তারগুলো খেয়ে ফেলছে।৷ তারা ইঁদুর তাড়ানোর জন্য আওয়াজ করতে করতে বাইরে এলেন। তখন মুসিল বীণা রেখে দিয়ে মাতাপিতাকে জানালেন তিনি আচার্যের কাছে শিক্ষাপ্রার্থী, তাই সুদূর উজ্জয়নী থেকে এখানে এসেছেন। গুপ্তিলের অভিভাবকেরা জানালেন তিনি কার্যোপলক্ষ্যে নগরের বাইরে, তবে আজই প্রত্যাবর্তনের কথা। মুসিল অপেক্ষা করতে লাগলেন।
গন্ধর্ব গুপ্তিল গৃহে ফিরে আসার পর, মুসিলের সাথে শিষ্টাচার পূর্বক আলাপ করলেন, মুসিল তার আগমনের কারন ব্যক্ত করে, বিদ্যাশিক্ষার অনুরোধ জানালেন। গুপ্তিল শুধু বীণা বাদনে পারদর্শী ছিলেন না, তিনি অঙ্গ বিদ্যায়ও নিপূন ছিলেন।। মুসিলের দেহ সৌষ্টব দেখে তিনি বুঝতে পারলেন এই ব্যক্তি সৎ নয়,তাই তিনি তার প্রস্তাবে অসন্মতি জানিয়ে তাকে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানালেন। কারন এই বিদ্যা তার জন্য নয়। কিন্তু চতুর মুসিল, গুপ্তিলের মাতাপিতার পদবেষ্টন করে তাদের কে এমন অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন যে, তাঁরাও তার প্রতি দয়া পরবশ হয়ে গুপ্তিলকে পুনঃ পুনঃ মুসিলের সপক্ষে আবেদন করতে লাগলেন। পিতামাতার অনুরোধ গুপ্তিলের কাছে আদেশ, তাই তিনি তাদের অনুরোধে মুসিলকে বীণা বাদন শিক্ষায় সন্মত হলেন। শুরু হলো মুসিলের বিদ্যাচর্চা। ইহার কিছু দিন বাদে, গুপ্তিলের সাথে মুসিল বারানসীর রাজভবনে উপস্থিত হলেন, যেখানে রাজ দরবারে তিনি একজন গন্ধর্ব ছিলেন। রাজা নবাগতকে দেখে প্রশ্ন করলেন ইনি কে। গুপ্তিল জানালেন ইনি আমার নবাগত অন্তেবাসী, আমার গৃহে থেকেই বীণা বাদন শিক্ষা করছেন। রাজভবনে যাতায়াত করতে করতে চতুর মুসিল ক্রমশঃ রাজার বিশ্বাস ভাজন হয়ে উঠলো।
এদিকে গুপ্তিল নিষ্ঠার সাথে মুসিলকে শিক্ষা দিতে লাগলেন। তিনি অন্য গুরুদের মত সব না শিখিয়ে, একটু রেখে দিয়ে শিক্ষা দিতেন না। গুপ্তিল সেই প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। তিনি তাঁর সমস্ত অধীত বিদ্যা উজার করে দেবার পর, মুসিলকে জানালেন যে তার শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। জম্বুদ্বীপের মধ্যে বারানসী শ্রেষ্ঠ। মুসিল তখন ভাবতে লাগলো, আমিও এখন গন্ধর্ব বিদ্যায় গুপ্তিলের সমান পারদর্শী এই জম্বুদ্বীপে। আচার্য বয়োঃবৃদ্ধ, তাই আমি এখন এখানেই অবস্থান করবো। যেমন ভাবা তেমন ব্যবস্থা। সে গুপ্তিলকে জানালো সে আর উজ্জয়নীতে ফিরে যাবে না, সে বারানসী রাজের সেবা করতে চায়। রাজসভায় গিয়ে গুপ্তিল মুসিলের ইচ্ছা মহারাজকে নিবেদন করলেন। রাজা মশাই সন্মত হলেন তবে গুপ্তিলের অর্দ্ধেক বেতনে মুসিলকে নিয়োগ করতে ইচ্ছুক হলেন। কিন্তু দুষ্ট মুসিল সেই প্রস্তাবে রাজী না হয়ে গুপ্তিলের সমান সন্মাননা দাবী করলো কারন সেও গুপ্তিলের সমান গন্ধর্ব বিদ্যায় পারদর্শী। তারজন্য সে গুপ্তিলের সঙ্গে স্পর্ধা প্রকাশ করতেও দ্বিধা বোধ করলো না। রাজা কিন্তু তাকে আচার্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে নিষেধ করলেন, তবু অশিষ্ট মুসিল, রাজার উপদেশে কর্ণপাত না করে গুরুর বিরুদ্ধে লড়াই করার বাসনা নিয়ে, রাজাকে আগামী সাতদিনের পর উভয়ের পরীক্ষা নিতে অনুরোধ করলে, রাজা অগত্যা সন্মতি প্রদান করলেন।
এদিকে গুপ্তিল ভীষন চিন্তায় পড়ে গেলেন যে, এখন তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন,হীনবলও, আর এই মুসিল তরুন, বলবান। আমি যদি জিতি, তেমন কোন বিশিষ্ট গৌরব লাভ হবে না, কারন তাঁর গুনের, কলার পরিচয় সবাই জানে। কিন্তু যদি আমি আমার অন্তেবাসীর কাছে পরাজিত হই, সে বড় লজ্জার কারন হবে। তাই গুপ্তিল স্বেচ্ছা মরন স্হির করলেন এবং বনে গমন করলেন প্রান বিসর্জনের জন্য, কিছু দূর গিয়ে আবার প্রত্যাবর্তন করলেন ভয়ে। এই মানসিক দোলাচলের মধ্যে ছয়দিন তিনি গৃহে ও বনে শুধু বারবার যাতায়াত করলেন। তাঁর এই গমনাগমনের ফলে বনের ঘাস পায়ের চাপে মারা গেলো, আর বনভূমি তে একটা পৃথক পথ তৈরী হয়ে গেলো। তাঁর এই চলাচলের কম্পনে শত্রুর(ইন্দ্র) আসন টলে উঠলো। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করলেন গন্ধর্ব গুপ্তিল মুসিলে শঠতা ও ক্ররতায় মহা দুঃখ পেয়ে আজ ছয়দিন ধনে বনের পথে অনবরত চলা ফেরার ফলে কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি গুপ্তিলকে সাহায্য করার মানসিকতায় দ্রুতবেগে তাঁর সামনে এসে উপস্হিত হলেন। গুপ্তিল শত্রুকে(ইন্দ্র) কে দেখে কিঞ্চিত ভীত হয়ে প্রশ্ন করলেন যে তিনি কে এবং কেন তার কাছে এসেছেন। ইন্দ্র নিজের পরিচয় দিলে গুপ্তিল তাকে জানালেন,হে দেবরাজ, তারই শিষ্য তাঁকে বীনাবাদনে স্পর্ধা প্রকাশ করে হারাতে চায়, সেই ভয়ে তিনি বনে চলে এসেছেন। হে কৌশিক ( ইন্দ্রের আর এক নাম) আমাকে রক্ষা করুন। তখন দেবরাজ তাঁকে আশ্বস্ত করে জানালেন প্রতিযোগীতার সময় তিনি তাঁর সহায়ক হবেন। ভয়ের কোন কারন নেই। দেবরাজ গুপ্তিলকে নির্দেশ দিলেন, বীনা বাদনকালে একটা তার ছিঁড়ে ছয় তারে বাজাবেন। বীনার প্রথম তারটাকে ভ্রমর তন্ত্র বলে। মুসিলও আপনাকে অনুকরন করবে। কিন্তু সে আপনার মত বীনায় সুর তুলতে পারবে না। এভাবে আপনি ২য়,৩য় থেকে সপ্তম তার পর্যন্ত সব কটা তার ছিঁড়ে ফেলে শুধু দন্ডটাই বাজাতে থাকবেন, তাই থেকেই সুর নিঃসৃত হবে, যা দ্বাদশ যোজন দূর বারানসী নগরী ছড়িয়ে যাবে। বীণার শব্দ যখন সমস্ত নগরী পরিপূর্ণ হবে, তখন আপনি একটা গুটিক (অক্ষ ক্রীড়ার গুটি জাতীয়) আকাশে দিকে ছুঁড়ে দেবেন তখনই তিনশত অপ্সরা অবতড়ন করে নৃত্য শুরু করবে। এভাবে তিন বার করবেন, আর অপ্সরাদের অবতড়ন হতে থাকবে। আমি উপস্হিত থাকবো, শঙ্কার কোন কারন নেই। আপনি ছাড়া আমাকে আর কেউ দেখতে পারবে না।
পরের দিন যথাসময়ে রঙ্গমন্ডলে সবাই উপস্থিত হলেন। রাজা তার নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করলেন,আমাত্য ও পুরনারীদের সাথে। গন্ধর্ব গুপ্তিল প্রস্তুত হয়ে নিজ আসন গ্রহন করলেন। দেবরাজ শত্রু অলক্ষ্যে সেখানে হাজির হলেন,একমাত্র গুপ্তিলই তাঁকে দেখতে পেলেন। মুসিলও নির্দিষ্ট আসন গ্রহন করে প্রতিযোগীর জন্য প্রস্তুত হলো।
প্রথমে দুজনে একইবরকম ভাবে বীণা বাজাতে শুরু করলেন।এরপর অন্তরীক্ষ থেকে দেবরাজের নির্দেশে গুপ্তিল বীণার প্রথম তারটি ছিঁড়ে ফেললেন, কিন্তু তাতে সুরের কোন তারতম্য ঘটলো না। তা দেখে মুসিলও তাকে অনুসরন করলো। তবে বীণার সুরে কিঞ্চিত ব্যতিক্রম হলেও সে বাজানো অব্যাহত রাখলো। এবার গুপ্তিল দেবরাজের ইশারায় একে একে সব তারগুলো ছিঁড়ে ফেলে শুধু বীণার দন্ডের সাহায্যেই সুরের ঝংকার তুললেন। মুসিলও তাকে অনুকরন করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লো, কারন শুধু মাত্র দন্ডের সাহায্যে সুরের ঝংকার তোলা তার দ্বারা সম্ভব ছিলো না, এবং সে ব্যর্থ হলো। পরিপূর্ণ রঙ্গমন্ডলে সবাই গুপ্তিলের অভূতপূর্ব বীণা বাদনে আশ্চর্য হলে গেলো। দেবরাজের নির্দেশে গুপ্তিল উপরের দিকে তিন বার গুটিক উৎক্ষেপ করলে, শয়ে শয়ে অপ্সরাদের আগমনে ও নৃত্যে ভূমন্ডলে আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো,সবাই গুপ্তিলকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। তখন রাজা ও নাগরিকরা মুসিলকে এই প্রতিযোগিতা করার জন্য দোষারোপ করতে লাগলো। কেউ ইট, পাথর যা পেলো তাই দিয়ে তাকে আঘাতের পর আঘাত করলে মুসিলের প্রানবায়ু সেখানেই নির্গত হয়ে গেলো। ক্ষিপ্ত নাগরিকরা এরপর তার মৃতদেহ কে পা ধরে টেনে আবর্জনার স্তুপে ফলে দিলো।
এদিকে গুপ্তিলের বীণাবাদনের অপূর্ব কলাকৌশলে তুষ্ট হয়ে রাজা বারিবর্ষণের মত ধনবর্ষা করতে লাগলেন গুপ্তিলের উপর। চারিদিকে শুধু তারই জয় গুঞ্জিত হতে লাগলো। সমস্ত অনুষ্ঠানের সমাপ্তির পর দেবরাজ গুপ্তিলকে রথে করে দেবলোকে নিয়ে গেলেন কারন সেখানে দেবকন্যারা অধির আগ্রহে গুপ্তিলের সংগীত সুধা পান করার জন্য অপেক্ষা করছেন। গুপ্তিল স্বর্গে সেই অনিন্দ্য কান্তি,অপূর্ব সুন্দর দেবকন্যাদের সংগীত পরিবেশনে সন্মত হলেন কিন্তু পারিশ্রমিক হিসাবে চাইলেন তাদের পূর্ব জন্মের কি পূণ্য কর্মের জন্য তাদের দেবলোক প্রাপ্তি ঘটেছে, সেই কল্যান কর্মের কাহিনী তাকে জানাতে হবে। দেবকন্যারা রাজী হলে, গুপ্তিল সপ্তাহকাল ধরে, বীনা বাজিয়ে তাদের মনোরঞ্জন করলেন। দেবকন্যারা তার মধুর সংগীতের জাদুতে মোহিত হয়ে গেলো।
প্রতিশ্রুতি মত তারা এবার নিজেদের পূর্ব জন্মের কুশল কর্মের বৃতান্ত শুরু করলো। পূর্ব জন্মে অনেকেই কাশ্যপ বুদ্ধের সময়ে কেউ ভিক্ষুকে বস্ত্র দান করেছেন, কেউ বা চৈত্যে গন্ধ পুস্প দান করেছেন, আবার কেউ জলে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুর ভোজন শেষ হলে তাকে পাণীয় জল দান করে তৃষ্ণা নিবারন করেছেন। কেহ বা ধর্ম কথার নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন। গৃহে থেকে শ্বশুড় শাশুড়ীকে নিত্য সেবা দান করেছেন। এ ভাবে প্রত্যেকে কিছু না কিছু দান করে, তা সে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, দেবলোকে জন্ম গ্রহণ করেছেন সেই পূন্য প্রভাবে। দেবকন্যাদের এরুপ দানের ফলশ্রুতিতে গুপ্তিল অভিভূত ও আনন্দিত হলেন। তার মাঝে এক নতুন উপলব্ধির জন্ম হলো যে সামান্য দানেও দিব্য ঐশর্য্য লাভ করা যায়। তাঁর মনে দান চিত্ত জাগরিত হলো। দানাদির মাহাত্য তিনি বুঝতে পারলেন এবং স্হির করলেন ফিরে গিয়ে তিনিও দান ও কুশল কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। দানের অকল্পনীয় ফলের মহিমা তাঁকে দান কর্মে উদ্বুদ্ধ করে তুললো।
দানে মানুষের লোভের ক্ষয় হয়, চিত্তের প্রসারতা বাড়ে। অন্যের উপকারের সাথে নিজেরও উপকার সাধিত হয়। আর সেই উপকার হলো জগতের সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ভাব পোষন করা। সর্বদা কুশল কর্মের সাথে নিজেকে সংপৃক্ত রাখা। এই ভাবে তথাগত গৌতম বুদ্ধ তাঁর শ্রাবক কূলকে দানের মহিমা ব্যক্ত করেছিলেন গুপ্তিল গন্ধর্বের কাহিনির মধ্য দিয়ে। তাঁর এই ছোট ছোট পূর্ব জন্মের বৃতান্ত যা জাতক কথায় লিপিবদ্ধ রযেছে তা এক কথায় অনবদ্য। সহজ সরল পদ্ধতিতে সকলের বোঝার ও ধারন করার সক্ষমতার দিকে দৃষ্টি দিয়েই তিনি তাঁর অমৃত কথা লোক সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সেই জন্মে তিনি ছিলেন সেই গন্ধর্ব গুপ্তিল, দেবদত্ত ছিলেন মুসিল, আনন্দ ছিলেন বারানসী রাজ এবং অনিরুদ্ধ ছিলেন দেবরাজ শত্রু(ইন্দ্র)।।
আলপনা বসু
কাঁকুড়গাছি
কলকাতা ৭০০০৫৪