Bhante Sumanapal
Kolkata, West Bengal.
আলোর ফেরিওয়ালা ড. সুমনপাল : গেরুয়া বসনে জ্ঞানী সুজন
এস. জ্ঞানমিত্র ভিক্ষু
:::::::::::::::::::
দুই বাংলার প্রতিথযশা গবেষক, লেখক, অনুবাদক, প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রাচীন লিপি বিজ্ঞান বিশারদ, হিন্দি-ইংরেজী-সংস্কৃত-পালি-চায়নিজ-তিব্বতী ভাষায় পারদর্শীতা সম্পন্ন বাঙালী বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত ড. সুমনপাল ভিক্ষু। তিনি আমাদের সময়ের এক আলোর ফেরিওয়ালা। উত্তুঙ্গ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই বৌদ্ধ ভিক্ষু বিবিধ বিষয়ে অসাধারণ পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন, যা বর্তমান সময়ের, তাঁর সমকালীন বাঙালি বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘের মধ্যে অনন্যই বলা চলে। অনুজদের প্রতি তাঁর স্নেহ, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি গারবতা, শিক্ষানবীশদের প্রতি নিঃস্বার্থ পৃষ্ঠপোষকতা, বিদ্ব্যৎজনদের প্রতি গৌরব, রোগাতুরদের প্রতি সেবাপরায়ণতা, অতিথি বাৎসল্যতা, নিরভিমানীতা, কৃতজ্ঞপূজারী প্রভৃতির মিশেলে এক ‘যথার্থ মানুষ’ ড. ভিক্ষু সুমনপাল।
এই কৃতি মানুষটি চট্টগ্রাম জেলাস্থ রাঙ্গুনিয়া থানার কর্ণফুলী বিধৌত শিলক গ্রামে ০৭ অক্টোবর ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ, ২২ আশ্বিন, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ, রবিবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম (শিক্ষক) দুলাল বড়ুয়া ও মাতার নাম সঞ্জু রাণী বড়ুয়া। তাঁর গৃহিনাম ছিল শুভাশিস বড়ুয়া। নিজগ্রাম শিলক ডাউলিং প্রাইমারী বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকোনোর পর তিনি শিলক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান হতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক ও ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গুনিয়া কলেজ হতে উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ব্রহ্মচর্য পন্থা অবলম্বন করেন এবং ‘সুমনপাল’ নামধারণ করেন। অতঃপর তিনি কলকাতাস্থ সংস্কৃত কলেজ হতে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. (সম্মান) পালি বিভাগ হতে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, এ সময় তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্য ক্লাস করতে গিয়ে বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজেও শিক্ষা গ্রহণ করেন; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগ হতে এম.এ. এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ‘Buddhism in Chaina: Introduction to 10th Century A.D’ শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে পি.এইচ.ডি.ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে চাইনিজ, তিব্বতী ও হিন্দি ভাষা কোর্সে ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেন। এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হতে Manuscriptology(পাণ্ডুলিপি বিজ্ঞান) ও Palaeography (প্রাচীন লিপি বিজ্ঞান [প্রত্নভূগোল])’র উপর ডিপ্লোমা করেন। তিনি সুত্র-বিনয়-অভিধর্ম বিশারদ উপাধিও অর্জন করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে জাতীয় শিক্ষাবৃত্তি এবং Indian Council for Cultural Relations হতে দুই দুই বার শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন।
অল্প বয়সেই তিনি বহুবিধ প্রতিভার সাক্ষর রেখে সমাজ ও সদ্ধর্মের সেবা করে চলেছেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অনুষ্ঠিত বহু সেমিনারে অংশগ্রহণ ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি U.G.C. (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন) আয়োজিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেমিনারে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এছাড়াও ষোলটি জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মশালায় যোগদান করেন।
ড. সুমনপাল ভিক্ষু Asiatic Society, Indian History Congress, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, Institute of Historical Studies, শান্তি নিকেতন আম্বেদকর বুদ্ধিষ্ট ওয়েলফেয়ার মিশন প্রভৃতি বিখ্যাত সংস্থা’র আজীবন সদস্য, এবং পণ্ডিত ধর্মাধার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ট্রাস্টি ও বিদর্শন শিক্ষা কেন্দ্র, কলকাতা’র গভর্নিং বডির সদস্য।
এ পর্যন্ত তাঁর বারটি গবেষণামূলক প্রকাশনা ও ত্রিশটি সম্পাদকীয় প্রকাশনা এবং আটটি গ্রন্থ সমীক্ষা বিদ্যমান। তিনি দুই বাংলায় সমাদৃত গবেষণামূলক বার্ষিক সাময়িকী ‘নালন্দা’র বর্তমান সম্পাদক। এছাড়াও তিনি ‘বোধিনিধি’ পত্রিকা ও প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে এবং বোধিনিধি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে রত।
ড. সুমনপাল ভিক্ষু কর্তৃক অনুবাদিত, সম্পাদিত ও গবেষণাকৃত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- (যেগুলোর নাম সংগ্রহ করতে পেরেছি)
পালি হতে অনূদিত-
১.‘থেরী অপাদান’,
২.‘অনাগত বংশ’,
৩.‘বিভঙ্গ’,
৪.‘জাতক নিদান’,
৫.‘বিশুদ্ধিমার্গ’,
৬.‘চুল্লবর্গ’,
৭.‘কর্মবাচা’,
৮.‘চুল্লবংশ’,
৯.‘সদ্ধম্মোপায়ন’,
১০.‘দীপবংশ’,
১১.‘সংযুক্ত নিকায়’-৫ম খণ্ড; প্রভৃতি
ইংরেজী হতে অনূদিত-
১২.‘জীবন’ (মূল- মাস্টার শিন্ উইন), ১৩.‘আধুনিক কালে সামাজিক সমস্যা এক অধ্যয়ন’ (মূল- মাস্টার শিন্ উইন)প্রভৃতি;
হিন্দি হতে অনূদিত-
১৪.‘তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম’ (মূল- রাহুল সাংকৃত্যায়ন) অনুবাদ করেন প্রভৃতি ।
গবেষণামূলক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো-
১৫.‘শিক্ষা প্রসঙ্গে’,
১৬. ‘বুদ্ধের নীতি তত্ত্ব’;
১৭.‘প্রাচীন ভারতে ভৌত রসায়ন বিজ্ঞান’ (ড.আশা দাশের সাথে যৌথ ভাবে),
১৮.’আনন্দ স্থবির, অঙ্গুলিমাল স্থবির ও বুদ্ধঘোসোৎপত্তি- জীবন চরিত’,
১৯. ‘মহান ভিক্ষুত্রয়ের জীবন চরিত’,
২০.’বিমল স্রোতে শাসনতিলক বিমলজ্যোতি’,
২১.’অনাগত বুদ্ধ মৈত্রেয়’,
২২.’বঙ্গীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু সঙ্ঘ ও গৃহী বৌদ্ধ সঙ্ঘের প্রগতির লক্ষ্যে’ প্রভৃতি ।
সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হল-
২৩. ‘মধ্যম নিকায়’ (অখণ্ড সংস্করণ),
২৪.‘বৌদ্ধ ভারত’,
২৫.‘বুদ্ধদেব’,
২৬.‘বৌদ্ধদের দেবদেবী’,
২৭.‘অশোক লিপি’,
২৮.‘ধর্মপদ’,
২৯.‘মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম’,
৩০.‘বালাবতার’,
৩১. ‘সুবোধালঙ্কার’,
৩২.‘চরিয়া পিটক’,
৩৩. ‘পাচিত্তিয় পালি’,
৩৪.‘মহাসতিপট্ঠান’,
৩৫.‘গৃহী বিনয়’,
৩৬.‘অভিধর্মার্থ সংগ্রহ’,
৩৭.‘থেরী গাথায় নারী জীবন’,
৩৮.‘কচ্চায়ন ব্যাকরণ’,
৩৯.‘অমল বড়ুয়া প্রবন্ধ সংগ্রহ’,
৪০.‘সুত্ত নিপাত’,
৪১.‘প্রেত বত্থু’,
৪২.‘বিমান বত্থু’,
৪৩.‘সদ্ধর্ম সহচর’,
৪৪.‘বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন’,
৪৫.‘ধাতুকথা’
৪৬. ‘নালন্দা’
৪৭.’বোধিনিধি’ প্রভৃতি;
কবিতা সঙ্কলন- ৪৮.‘বৌদ্ধায়ন’ ও ৪৯. The Path Finder;
ওপার বাঙলার খ্যাতিমান বৌদ্ধ ব্যক্তিত্বগেণর জীবনী সঙ্কলন- ৫০.‘বোধিরশ্মি’ প্রভৃতি। এবং পিএইচডি অভিসন্দর্ভ (প্রকাশিত) ৫১.Buddhism in Chaina: Introduction to 10th Century A.D’
এছাড়াও তিনি শতাধিক ইংরেজী-বাংলা প্রবন্ধ রচয়িতা যেগুলো ভারত-বাংলাদেশ সহ বিশ্বের দেশের জার্নালে প্রকাশিত।
পণ্ডিত ড. সুমনপাল ভিক্ষু মহোদয় বর্তমানে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা রত। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কত ছাত্র-ছাত্রী যে উপকৃত হয়েছে, কত ছাত্র-ছাত্রী যে শিক্ষা উচ্চতর পর্যায়ে যাবার ক্ষেত্রে সহায়তা পেয়েছে তা উল্লেখযোগ্য অবশ্যই। এই ছাত্রবান্ধব ভিক্ষুটি ছোটখাট সাদামাটা দেহবল্লরী নিয়ে চষে বেড়ান সারা কলকাতা বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও বৌদ্ধবিদ্যার বিকাশে। কত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, কত চিত্র প্রদর্শনী, বৌদ্ধ বিদ্যা ও সংস্কৃতির কল্যাণে-বিকাশে যে তিনি দিন-রাত এক করে ছুটে বেড়ান তা না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিন। সদ্ধর্মের কল্যাণে ভান্তের নিরোগ-দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
bodhinidhi.blogspot.com