Bhikshu Upali by: Alpana Basu

Bhikshu Upali by: Alpana Basu

ভিক্ষু উপালী — একটি উজ্জ্বল জীবন , আলপনা বসু ।

বুদ্ধের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভিক্ষু ছিলেন উপালি। তিনি বুদ্ধের প্রধান দশ শিষ্যের  একজন। তিনি কপিলাবস্তুর এক নিম্নবর্গের নাপিতের ঘরে জন্ম গ্রহন করেন।শৈশবেই সিদ্ধার্থের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ  ঘটে।। সেই সময় তার নাম ছিলো “পূর্ণ”. ওনার মাতার নাম ছিলো মন্তানী। পূর্ণ ছিলেন অনুরুদ্ধ, ভৃগু, কোম্বিল, আনন্দ, দেবদত্ত রাজকুমারদের সহচর।।

রাজকুমারদের সাথেই তার বেড়ে ওঠা।

প্রাচীন কালে, নিম্নবর্গের পরিবারের শিক্ষার কোন অধিকার ছিলো না। তাই বয়োঃবৃদ্ধির সাথে তার পিতা তাকে পারিবারিক ব্যবসার কাজে নিয়োগ করলেন তার সহায়তার জন্য। তাই পূর্ণ রাজপরিবারের নাপিত হয়ে উঠলেন। শীঘ্রই নিজের কাজে দক্ষতা লাভ করলেন। মহাবস্তু পুস্তকে পাই পূ্র্ণ শৈশবেই সিদ্ধার্থের মস্তক মুন্ডন করেছিলেন।

গৌতম বুদ্ধ যখন অনুপ্রিয় নামক আম্রকাননে অবস্থান করছেন তখন অনিরুদ্ধ, ভৃগু, আনন্দ সহ ৮ জন রাজকুমার বুদ্ধের কাছে প্রবজ্জা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই ভেবে তারা কপিলাবস্তু থেকে রওনা হয়ে, তারা অনুপ্রিয় বনের কিছু দূরে এসে থামলেন। পূ্র্ণও তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। রাজকুমারগন পূ্র্ণের হাতে তাদের অলংকার, মূল্যবান বস্ত্র, ইত্যাদি সব তার হাতে দিয়ে দিলেন এবং তাকে কপিলাবস্তুতে ফিরে যেতে বললেন। নিজেরা বুদ্ধের শরণ নিতে চলে গেলেন। পূর্ণ তখন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরলেন। ভাবতে লাগলেন এই মূল্যবান সমগ্রী যদি কপিলাবস্তু তে নিয়ে ফিরে যাই, তাহলে শাক্যগন আমার কথা বিশ্বাস করবে কেন। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা ও চুরির অভিযোগ আসতে পারে।  তিনি আরও চিন্তা করলেন শুদ্র কূলে তাঁর জন্ম, এই পোষাক, গহনা তাঁর উপযুক্ত নয়। তাছাড়া এই রাজপুত্র গন ধনী, প্রভাবশালী, তারা যদি সব কিছু পরিত্যাগ করে শাক্যমুনির কাছে প্রবজ্জা গ্রহন করতে পারে, তাহলে আমি কেন পারবো না? যেমন ভাবা তেমন কাজ তিনি, গাছের ডালে মূল্যবান জিনিসপত্র ঝুলিয়ে দিয়ে বুদ্ধের পথে গমন করেন, যে পথে রাজকুমারগন যাত্রা করেছেন। উপালীর প্রবজ্জা গ্রহনের কাহিনীর বিভিন্ন পাঠান্তর পাওয়া যায়, তবে নিম্নবর্গীয় হওয়া সত্বেও বুদ্ধের সংঘে তাঁর স্হান যে উচ্চ মর্য্যাদা সম্পন্ন ছিলো, এ বিষয়ে কোন দ্বিধা নেই।

অনিরুদ্ধ,  ভৃগু, আনন্দ, প্রমূখ বুদ্ধের কাছে গিয়ে প্রবজ্জা প্রার্থনা করলেন, তখন পূর্ণ পথের পাশে বসে কি ভাবে বুদ্ধের কাছে পৌঁছবেন, সেই কথা ভেবে দুখী হলেন ও ক্রন্দন করতে লাগলেন।  তিনি থমকে গেলেন, কারন তিনি নীচু জাতির বংশোদ্ভূত। সহসা তিনি শুনতে পেলেন কেউ তাকে প্রশ্ন করছেন ‘ তুমি এত দুখী কেন?’ পূর্ণ চোখ তুলে দেখতে পেলেন স্বয়ং শারিপুত্ত বুদ্ধের প্রধান শিষ্য তার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখের জল মুছে, নতজানু হয়ে প্রশ্ন করলেন,’ হে ভদন্ত, একজন নিম্নকূল জাত আমার মত,  সে কি বুদ্ধের সংঘে প্রবেশ করতে পারবে?’ শারিপুত্ত বললেন, বুদ্ধের দরবারে সবাই  স্বাগত, যে কেউ বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহন করতে পারে, যদি সে শ্রদ্ধা চিত্তে শাস্তার অনুশাসন, আদর্শ, সদ্ধর্মকে পালন করে। তুমি আমার সাথে এসো, শাক্যমুনি অবশ্যই তোমাকে উপসম্পদা প্রদান করবেন। পূর্ণ  শারিপুত্তকে অনুসরণ করলেন।

পালি গ্রন্থসমূহে উল্লেখ আছে অনুরুদ্ধ সহ বাকি রাজপুত্ররা পূর্ণ কে আগে উপসম্পদা দানের জন্য বুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে সংঘে পূর্ণের অগ্রাধিকার আগে গৃহীত হয় এবং রাজকুমাররাও তাদের বংশমর্যাদা, অহংকার, বর্ণব্যবস্হা ইত্যাদির থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেন। বুদ্ধ বললেন, আমি পূর্ণ কে আগে উপসম্পদা দান করবে, তবে তোমাদেরও তাঁকে যথাযোগ্য সন্মান জানাতে হবে। বুদ্ধের এই করুনায় পূর্ণ ভীষন ভাবে আপ্লুত হলেন, সসন্মানে বুদ্ধের চরনে নতজানু হয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। বলা যায় এও একরকম বর্ণ,জাতিবাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ যা বুদ্ধের সময়ে সংগঠিত হয়েছিলো। রক্তপাতহীন বিদ্রোহ। প্রবজ্জা গ্রহনের পর পূর্ণ  “উপালী” নামে অভিসিক্ত হলেন। শিষ্যত্ব গ্রহনের পর বাকি রাজপুত্ররা যখন উপালীকে নতমস্তকে অভিবাদন করলেন, তাই দেখে রাজা বিম্বিসার ও তাঁর আমাত্যদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরী হয়েছিল যে তাদেরকে কি উপালীকে প্রনাম করতে হবে, কিন্তু বুদ্ধের অনুরোধে তারাও উপালীকে সন্মান জানান। তখন তথাগত একটি জাতক কাহিনী বলে রাজা ও তার সাথীদের বললেন, এর আগেও পূর্বজন্মে তারা উপালীকে নতমস্তকে প্রনাম করেছিলেন। চারিদিকে এই ঘটনা রাস্ট্র হয়ে গেলো যে বুদ্ধের নির্দেশে রাজকুমার, রাজা, আমাত্যগন সকলে পূর্বাশ্রমের নাপিত,  বর্তমানে উপালিকে অভিবাদন করেছেন। বর্ণাশ্রমের, জাতিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ, আর এখানেই  তিনি সবার থেকে আলাদা, শ্রেষ্ঠ।।

শিষ্যত্ব গ্রহনের পর উপালী বুদ্ধের কাছে অরন্যে গিয়ে ধ্যান সাধনা করার অনুমতি চাইলে, বুদ্ধ তাঁকে অনুমতি না দিয়ে, বললেন, বনে বিদর্শন ভাবনা করলে তিনি শুধু ভাবনাতে আবদ্ধ থাকবেন, সেটাই শিখবেন, কিন্তু যদি বাকিদের সাথে বিহারে অবস্থান করেন, তাহলে ধ্যান সাধনার সাথে বুদ্ধের চার আর্যসত্য,অষ্টাঙ্গিক মার্গ ইত্যাদির জ্ঞান লাভ করতে পারবেন। উপালি খুব বাধ্য প্রকৃতির ছিলেন, তিনি বুদ্ধের আদেশকে শিরোধার্য করে, শাস্তার উপদেশ ও ধ্যান উভয়েরই চর্চা করে অচীরেই অর্হত্ব ফল লাভ করলেন। বুদ্ধ নিজে উপালীকে সমগ্র “বিনয়” অর্থাৎ ভিক্ষুদের আচরনের নির্দেশাবলী শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং উপালী তার যথাযোগ্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছিলেন,তাই বুদ্ধ নিজে তাকে “ বিনয়ধর” উপাধি তে ভূষিত করেছিলেন।

উপালী খুব মনোযোগী ছাত্র ছিলেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধ যখন কপিলাবস্তু তে যান তখন উপালীর বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর। উপালী নিযুক্ত হয়েছিলেন বুদ্ধের কেশরাশি কাটার জন্য। পূর্ণ অর্থাৎ উপালী মাতার সাথে বুদ্ধের সমীপে উপস্থিত। পূ্ণ তার কাজ শুরু করার পর, মাতা বুদ্ধের কাছে এসে বললেন, “আপনি ওর যোগ্যতা সম্পর্কে  কি অভিমত দেবেন। “ বুদ্ধ ধীরে উত্তর দিলেন, “তাকে আর একটু কম নত হতে হবে। সে একটু বেশী নত”। এ কথা শুনে পূর্ণ তাড়াতাড়ি নিজেরকে সোজা করে, সিধে হয়ে দাঁড়ালো। কথিত আছে, সেই  সময়েই পূর্ণ বিদর্শনের প্রথম পাঠ শুরু করেছিলো। কিছু পরে তার মাতা আবার বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, হে বুদ্ধ, এখন তুমি কি মনে করছো, ওর যোগ্যতা নিয়ে।। বুদ্ধ জানালেন, ওর শরীর একটু বেশী সোজা, দৃঢ়। আবারও বুদ্ধের কথা শুনে পূর্ণ  নিজের মনযোগকে কেন্দ্রীভূত করলো। এভাবে সে ভাবনার ২য় ধাপে উপনীত হলো। আরও কিছুক্ষন বাদে পূর্ণ ‘র মাতা বুদ্ধকে আবার প্রশ্ন করলে “ হে প্রভু, এখন তুমি ওর এই কাজের দক্ষতার, কি বিচার করছো”। শাক্যমুনি জানালেন, সে খুব দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। বুদ্ধের মতামত পূর্ণের কানে পৌঁছাতেই সে তার শ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রন করা প্রারম্ভ করলো। এইভাবে পূর্ণ  ধ্যানের তৃতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হলো। পুনরায় তার মা, বুদ্ধের কাছে মতামত চাইলো।  সন্তানের কাজের কুশলতা নিয়ে প্রশ্ন করতেই, শাস্তা উত্তর দিলেন, ওর নিঃশ্বাস খুব দ্রুত।  মেধাবী পূর্ণ  এখন সত্যিকারের মনযোগী হয়ে শ্বাস নেওয়া ও নিঃশ্বাস ছাড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলো, যেটা ভাবনার ৪র্থ পর্যায় বলা হয়।এখানে আমরা একটা জিনিস  বুঝতে পার উপালী অর্থাৎ পূর্ণ খুবই মনযোগী নিজের কাজ সম্পর্কে।  আর নিজেও খুব শৃঙ্খলা পরায়ন ছিলেন। তিনি কোন সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করতেন না। খোলা মনে তা গ্রহন করার মানসিকতা তাঁর ছিলো। তাই  তিনি বুদ্ধের শিষ্যদের মাঝে বিশিষ্ট ছিলেন, যারা বুদ্ধের শৃংখলা পরায়নতা কে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন।।

বুদ্ধ উপালীকে খুবই পছন্দ করতেন তা বোঝা যায় যখন তিনি সবাই কে একত্রিত করে বোঝান যে সবাই কে নিয়ম, শৃংখলা অনুসরন করা উচিৎ। যারা নিয়মানুবর্তী হয়, তারা পবিত্র মনের অধিকারী, তারা একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার মত, কিন্তু মন্দ মনের ব্যক্তিরা অন্ধকারকেই বেশী ভালোবাসে।  নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ থাকাই ভালো, যেমন ‘উপালী,’ অত্যন্ত নিষ্টাবান ও শৃংখলাপরয়ান.। এর থেকেই বোঝা যায় বুদ্ধ উপালী কে কতটা স্নেহ করতেন। উপালী বুদ্ধের প্রতিটা নিয়মকে খুব কাছের থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন, এবং মনে রাখতেন শুধু  নয় কঠোর ভাবে তা পালন করতেন। ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা যখনই সংঘের,  নিয়মের কোন সংশয়ে পরতেন, তারা উপালীর কাছে ছুটে আসতেন, তাঁর পরামর্শ গ্রহনের জন্য। উপালী ছিলেন তাদের বন্ধু, ত্রাতা। সংঘ সমাবেশে বুদ্ধ উপালীকে বিনয় শিক্ষার সবচেয়ে দক্ষ ব্যক্তিত্ব  বলে ঘোষনা করেছিলেন। তাদের কে উপালীর এই নিয়ম নিষ্টার জন্য সন্মান করা উচিৎ বলেও জানিয়েছিলেন। ঐতিহ্য অনুসারে উপালীকে বুদ্ধের নিয়মাবলীর জন্য বিশেষ কতৃত্ব দেওয়া হয়েছিলো। বিনয় পিটকে “ উপালী পঞ্চকা” বা অঙ্গুত্তরনিকায় তে উপালী বগ্গে আমরা দেখতে পাই যে উপালী বুদ্ধের সাথে, “একজন অভিযুক্ত ভিক্ষুর অনুপস্থিতিতে, কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া, কতটা বৈধ, বা মন্ডলী পরিচালনার বিষয়েও পরামর্শ করছেন। তিনি আরও জানতে চাইছেন, যে যদি কোন একটা ঘটনা সংঘের সদষ্যদের মধ্যে বিবাদ ও বিভেদ সৃষ্টি করে, এবং সংঘ কোন রকম অনুসন্ধান বা তদন্ত না করে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, তা কতটা আইনত বৈধ হতে পারে। কোন একজন ভিক্ষু যদি কোন বিষয়ে নিজের উপর দায় নিতে চায়, তাহলে কোন পরিস্থিতিতে সে তা করতে পারবে? এছাড়াও তিনি জানতে চান, অন্যকে সচেতন বা সাবধান করার আগে, একজন ভিক্ষুর নিজের মাঝে  কি কি গুন থাকা উচিৎ? কোন কোন ক্ষেত্র একজন শিক্ষানবীশ ভিক্ষু বাধা প্রাপ্ত হতে পারে, যিনি শিক্ষনবীশির সময় ভাল ফল করেছেন?” এ ভাবে এক বিশাল তালিকা নিয়ে উপালী বুদ্ধের কাছে বিনয় সংক্রান্ত প্রশ্ন করেছেন, আর বুদ্ধ তাঁকে শান্ত চিত্তে বিনয় বিষয়ক সমষ্যার সমাধান করে দিচ্ছেন। উপালী বিনয়ের নিয়মগুলো সঠিজ ভাবে যাচাই না করে এবং তা বুদ্ধ মুখঃনিসৃত কিনা না জেনে বিনয় ভুক্ত করতেন না। তাই হয়তো বুদ্ধ বিনয় সংক্রান্ত বিষয়ে উপালীর উপর নির্ভর করতেন বলেই তাকে বনে গিয়ে ধ্যান সাধনা না করতে আদেশ দেন। তবে এটাও ঠিক যে সত্যি  কোন প্র্শ্নগুলো উপালী করেছিলেন, আর কোনগুলো তিনি তার পদাধিকার বলে সংযোজন করেছিলেন বলে দায়ী করা হয়, এ নির্নয় করা খুবই কঠিন। তবে বুদ্ধঘোষের মতে, বুদ্ধের জীবিত অবস্থায়, উপালী নিজে কিছু নির্দেশিকা তৈরী করেছিলেন, সেই অনুযায়ী ভবিষ্যত “বিনয়ধর” অর্থাৎ যারা উপালীর অনুগামী, তাদের কে বিনয়ের ব্যাখ্যা করতে বলেন এবং অন্যদের সাথে মিলিত ভাবে  তিনি বিনয়ের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত পাদটীকাও রেখে গেছেন।

বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের পর, প্রথম মহা সঙ্গীতি, যা ভদন্ত মহা কশ্যপের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিলো, সেখানে উপালীকে নির্বাচন করা হয়েছিলো বুদ্ধের সংঘের নিয়ম ও মীতির ব্যাখ্যাকার হিসাবে। কিন্তু উপালী বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখান করেন। কিন্তু মহা কশ্যপ তাঁকে অনুরোধ করেন তিনি যেন সেই  সন্মেলনে অবশ্যই অংশ গ্রহন করেন। কারন তিনি বুদ্ধ কর্তৃক সন্মানিত, “ বিনয়ধর” উপাধি তে ভূষিত।  বুদ্ধ  তাঁকেই শিখিয়েছিলেন তাঁর ১৪ টি নিয়ম এবং তিনি ছিলেন বাকি ভিক্ষুদের মধ্যে প্রসিদ্ধ, যারা বুদ্ধের “বিনয়” স্মৃতিতে ধারন করেছিলেন। সুতরাং সেই বিনয় তাঁকে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করেন। পরবর্তী তে ভিক্ষু উপালী সেই  মহা সন্মেলনে বিনয় পাঠ করে “বিনয়ধর” উপাধি র সার্থকতা বজায় রেখেছিলেন।

উপালী একজন নাপিতের ঘরের সন্তান হলেও তিনি সংঘে উচ্চ পদে আসীন ছিলেন।  তাঁর সাফল্য বাকি অসবর্ণের কাছে একটা প্রেরনা।  তাঁর সাফল্য এটাই বার্তা দেয় যে বুদ্ধের সমাজ সাম্যের, একতার, বর্ণবিদ্বেষ হীন এক আদর্শ সমাজ যার তুলনা পুরো বিশ্বে বিরল।

কথিত আছে পদুমুত্তর বুদ্ধের সময় তিনি এক ধনী  ব্রাহ্মণের পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছিলেন, তাঁর নাম ছিলো সুজাত। যখন পদুমুত্তর বুদ্ধ তাঁর পিতার শহরে আসেন দেশনার জন্য, সুজাত দেখেন বুদ্ধের এক শিষ্য  তার নাম সুনন্দ, সাত দিন ধরে ফুলের ছাতা পদুমুত্তর বুদ্ধের মাথায় ধরে রেখেছেন নিরলস ভাবে। বুদ্ধ ঘোষনা করলেন, সুনন্দ গৌতম বুদ্ধের সময় বিখ্যাত হবেন মন্তানী পুত্র হিসাবে। সুজাত মনে মনে আকাংঙ্খা করলেন তিনিও যেন গৌতম বুদ্ধকে দেখতে পান। এছাড়াও তিনি আরও অনেক পূন্যকর্ম সম্পদন করেন পূর্বজীবনে, তিনি পদুমুত্তর বুদ্ধের জন্য কোটি টাকা খরচ করে বিহার নির্মাণ করে দেন। যার ফল স্বরূপ তিনি স্বর্গে জন্ম লাভ করে দেবতাদের রাজা হয়ে বহু কল্প কাল কাটিয়ে দেন, এমন  কি চক্রবর্তী রাজাও হন। তারপর কয়েক কল্প আগে তিনি অন্জাসা নামে এক ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেন। তাঁর নাম হয় সুনন্দ। একদিন সুনন্দ শিরিকা নামে এক হাতির পীঠে চড়ে  যাবার সময় পথে “পাচ্চেক” বুদ্ধের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে ভীষন ভাবে অপমান করেন। এই অপমানের কারনে তার শরীরে এক তীব্র জ্বলন অনুভূত হতে থাকে। এটা ততক্ষন পর্যন্ত যায় নি যতক্ষন পর্যন্ত তিনি বুদ্ধের অনুগামীদের সাথে পাচ্চেক বুদ্ধের কাছে গিয়ে উপস্থিত হন নি। বলা হয়ে থাকে, বুদ্ধ যদি ওনাকে ক্ষমা না করতেন, তাহলে সমগ্র নগরী ধ্বংস হয়ে যেতো। এর ফলস্বরূপ পরবর্তী জীবনে তিনি নাপিতের গৃহে জন্ম নেন। যে হেতু তারও কয়েক কল্প আগে তিনি যে কুশল কর্ম করেছিলেন, তাই তিনি বুদ্ধের বিনয়ধর হতে পেরেছিলেন।

 

বুদ্ধ  আজীবন অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন  কোন অস্ত্র ছাড়াই।  তিনি বিশ্ববাসী কে প্রমান করে দেখিয়েছেন যে জন্মের ভিত্তিতে কেউ উচ্চ, নীচ হয় না। উপযুক্ত পরিবেশ, কাঠামো, শিক্ষা, পেলে যে কেউ উপালীর মত উচ্চ পদ মর্যাদা পেতে পারে। বুদ্ধ শুধু পুরুষ ভিক্ষুদের উপর নয়, সমাজে নিপীড়িত, বিতাড়িত, অত্যাচারিত নারীদের সংঘে আশ্রয় দিয়ে, তাদের সন্মান দিয়ে, উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সমাজে যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, তার মত মহা কারুনিকের পক্ষেই তা সম্ভব ছিলো।  তিনি বলেছেন সর্বদা, সর্বস্থানে শুধু পুরুষরাই পান্ডিত্য  ও নৈপুনতা প্রদর্শন করতে পারেন তা নয়। পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষা দিলে কোন কোন ক্ষেত্রে নারীও পুরুষদের অতিক্রম করতে সর্মথ। নিজের দৃঢ় চিত্ত,সংকল্প, মৈত্রী,, এর থেকে তিনি কোনদিন সরে আসেন নি।  এমন কি দেবদত্ত যখন স্বামী ঘাতিনী নারী, অন্তঃসত্ত্বা নারী, পতিতা নারী, নগরনটিদের সংঘে প্রবেশের জন্য বুদ্ধের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন , তখনও বুদ্ধ সংকল্প চ্যুত হন নি। সংঘভেদের পরিবেশ তৈরী হওয়া সত্বেও।  কারন হিসাবে তিনি বলেছিলেন “ এদের কে সংঘ থেকে বিতাড়িত করা মানেই  অকুশল কর্মকে উৎসাহ দেওয়া হবে, তাঁর সংঘ কুশল কর্মের জন্য গঠিত।  যে ধর্মের আদি,মধ্য ও অন্ত শুধু প্রানী জগতের কল্যানের কথাই বলে, সেই সদ্ধর্মের সুধা পান থেকে তিনি কাউকে বঞ্চিত করতে পারবেন না” উনি কেবল মানুষের কথা বলেন নি, জগতের সকল প্রানী সুখী হোক এই ছিলো তাঁর সন্দেশ। নিজে বাঁচো,অন্যকেও  বাঁচতে দাও।

উপালী, পটাচারা,কৃশা গৌতমী, অংগুলীমাল, আম্রপালি, কাশ্যপা এরা ছিলেন বুদ্ধের এক একটি হীরে।, ও কমল। বুদ্ধ জহুরীর মত এদের কে খাদান থেকে, পাঁক থেকে  এনে এমন সুন্দর ভাবে জগতের সামনে তুলে ধরেছিলেন,  তা তুলনারহিত। উপালী ছিলেন সেই রকমই এক রত্ন।

রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর বলেছেন,” যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলে ও পাইতে পারো অমূল্য রতন” ছোট বলে কাউকে নগন্য, তুচ্ছ মনে করা ঠিক  নয়। ক্ষুদ্র বস্তুর মধ্যেও মহামূল্যবান রতন থাকতে পারে। তাকে গবেষনা করে, তার মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তাকেই সামনে নিয়ে আসতে হবে। এতো বুদ্ধের কথারই প্রতিফলন তাঁর কাব্যের উচ্চারিত।

তথাগতের সংঘ ছিলো তেমনই এক গবেষণাগার। যেখান থেকে উপালীর মত এক  অসাধারন,বিস্ময়কর মানবের পুর্নজন্ম হয়। চীনে সপ্তম শতাব্দীতে বিনয় শাখাটি অন্যতম প্রবর্তক হিসাবে উপালীকে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বিশ্বাস করতেন যে উপালীই পুনঃজন্ম নিয়ে  তাদের পথপ্রদর্শক হয়েছেন।

উপালীর জীবন থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় থাকলে মানুষের অসাাধ্য কিছুই নেই। এরজন্য বংশমর্যাদা প্রয়োজন নেই,  প্রয়োজন শুধু সৎ কর্ম করার মানসিকতা।

এই রকম এক মহা জীবন,  যিনি মহা পরিনির্বান লাভ করেন,  রাজা উদয়ীভদ্দার রাজ সিংহাসন লাভের ৬ বছর পর। রাজা উদয়ী ভদ্দা ছিলেন রাজা অজাতশত্রুর পুত্র, যিনি পাটলীপুত্রের স্হাপনা করেছিলেন।

“সব্ব পাপস্য অক্রানম কুশলস্স, উপসম্পদা সচ্চিদা, পরিযোদনম এতম বুদ্ধশাসনম।“

নমো বুদ্ধায়

আলপনা বসু

কাঁকুড়গাছি

কলকাতা ৭০০০৫৪

About The Author

Tridib

An Education and Religious Book Publisher based in Delhi (India) associated with prominent Buddhist organisations and temple associations, including Mahabodhi Mahavihara Temple, Bodh Gaya (Bihar) India. Created this website "baruasamaj.com" in the year 2010-11 with a view to bring the members of Barua community to a common platform, and to make available all relevant information about the community.

Leave a reply

Your email address will not be published.

Follow Us

Recent Videos

Loading...