দুঃখ কিসে হয় – শ্রীমতী রঞ্জিতা তালুকদার
দুঃখ কিসে হয় –
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বুদ্ধের শিক্ষার আধারই হলো শান্তির সন্ধান। শরীর, মন, ও বাক্যের দ্বারা কুশল কর্ম করা, অথবা শরীর, মন ও বাক্যের দ্বারা অকুশল কর্ম না করাই হলো তাঁর মূল শিক্ষা। এই সহজ সরল কথাগুলো আমাদের জীবনে ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হলেও, পালন করা অতীব দুরুহ।
দুঃখময় জীবনে একটু সুখ-শান্তির জন্য মানুষ বিভিন্ন দেবদবীর পূজো, ধর্মগুরুর সান্নিধ্য, তীর্থ স্হানে পর্যটন, কত কি করে থাকে, তবুও কাঙ্খিত সুখ অধরাই থেকে যায়। প্রায় সমস্ত ধর্ম গ্রন্হে জন্মান্তরবাদ স্বীকৃত আছে। শুভ ও অশুভ কর্মের ফল, আমাদের ইহজীবন ও আগামী জীবনেও সুদূর প্রসারী। বর্তমান জীবনে আমরা যে সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করি, তা আমাদের ইহজীবনের বা পূর্ব জন্মের কর্মেরই ফল। প্রায় সকলকেই বলতে শোনা যায় যে আমি এত পূজাপাঠ করি,দানধ্যানাদি সৎ কর্ম করি তবুও আমার রোগভোগ,দুঃখদুর্দশা ঘোচে না বা ব্যক্তি বিশেষে নানা অন্যায়, অনাচার, অকুশল কর্ম করার পরেও, বিত্ত, বৈভব, সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ জীবন যাপন করছে। যদি নিরপেক্ষভাবে বিচার করি তাহলে দেখতে পাবো আমরা কর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাগ্যতে বেশী জোর দিই। মানুষের স্বভাবই হলো, জীবনে সে যা আয়ত্ত করে, তাতে সে কোনদিন সন্তুষ্ট হয় না, সসাগরা ধরণী করায়ত্ব হলেও তার তৃষ্ণার ক্ষয় হয় না। আর সেটাই তার দুঃখের আসল কারন। প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তিকে বিচার করলে দেখতে পাবো, তার মন সব সময় অশান্ত, বিভ্রান্তি ও অন্ধকারে পূর্ণ। ফলে জীবনে দুঃখ দেখা দেয়। পরিবর্তনশীল অবস্থা, অতিরিক্ত সুখভোগের ইচ্ছা ও স্বার্থপরতাই তার জীবনে দুঃখ নিয়ে আসে। অপূর্ণ ইচ্ছা থেকেই দুঃখের উৎপত্তি। অতএব বলা যায়, মানুষ নিজের দুঃখ নিজেই ডেকে আনে।
কিছু মানুষ জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না। কুশল-অকুশল কর্মের প্রভাবেই জন্মান্তর। তা না হলে কোন শিশুর জন্ম বিত্তবানের ঘরে আবার কোন শিশুর জন্ম ফুটপাথে, আবার কেউ জন্মমাত্রই পরিতক্ত হয়ে ঠাঁই পায় অনাথ আশ্রমে। কেহ বা রুপবান, কেহ কুরুপ, কেহ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কেহ চিররুগ্ন, কেহ বুদ্ধিমান, কেহ বা মন্দবুদ্ধি। এর সব কিছুর পিছনে আছে কার্য-কারন সম্পর্ক। কুশল-অকুশল কর্মের প্রভাব। কিন্তু মানুষ তা মানতে চায় না। নিজের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হলে আমরা অন্যের উপর দোষারোপ করি। নিজের দোষ দেখি না। নিজের দোষ অবশ্যই মেনে নিতে হবে, তা না হলে, দুঃখ কোনদিনই শান্তিতে থাকতে দেবে না। বিশ্বের যুক্তিবাদী মহামানব বুদ্ধের শিক্ষার আধারে শান্তি খুঁজতে যাই তবে তারই কথায় বলতে হয় “ যে মূর্খ নিজের মূর্খতা অবগত আছে, সে সেই পরিমান জ্ঞানী, কিন্তু যে মূর্খ নিজেকে পন্ডিত বলে ভাবে, তাকে যথার্থ মূর্খ বলা যায়”।
কর্মফলে বিশ্বাস থাকলে, যেসব সুখ-দুঃখ আমরা ভোগ করি, তা আমাদেরই কর্মফলের কারন বলে জানতে হবে। বাকীটা উপলক্ষ্য মাত্র। সবাইকে নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করতেই হবে, এর থেকে কোন নিস্তার নেই। একমাত্র অর্হতগামী ব্যক্তি সুখদুঃখ থেকে নিজেকে উর্দ্ধে তুলতে পারে। ভালোমন্দ সবই নিজের কারনে, এই চেতনা, বিশ্বাস থাকলে, শরীর, মন, ও বাক্যের দ্বারা অকুশল কর্ম না করা ও কুশল কর্ম করার প্রেরণা পাওয়া যায়। আমার সুখদুঃখের কারন আমি নিজেই,আর কেউ নয়, এই বিশ্বাসই মনে শান্তি নিয়ে আসে।
প্রত্যাশা মানুষের জীবনে অন্যতম দুঃখের কারন। কারও কাছে কিছু আশা করবে না, তাহলে কিছুই তোমাকে হতাশ করবে না। প্রতিদানের আশা ছাড়াই অপরের দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করবে। পুরস্কারের আশা ত্যাগ করলেই, মনোকষ্ট পাবে না কোন মানুষ হয়তো খুবই ভালো ও সৎ, তা সত্বেও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।।প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে, যে ভালো কাজ করেও কেন সমালোচিত হলাম। কারন, ভালো কাজ করতে গেলে কতকগুলো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়, যা আমাদের চারপাশে রয়েছে। শুধু দৃঢ় সংকল্প, এই হতাশাজনক পরিবেশ থেকে মুক্ত করে, জয়ের স্বাদ দিতে পারে। অপরকে রক্ষা করলে নিজেকে রক্ষা করা যায়, আবার নিজেকে রক্ষা করলে অপরকেও রক্ষা করা যায়। প্রত্যেকেই পরস্পরের মঙ্গলের জন্য কিছু না কিছু করতে পারে। বুদ্ধের এই উপদেশ স্মরণ রাখলে দুঃখ লাঘবের উপায়ও নিশ্চিত পাওয়া যাবে।
অহমিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সুখ ও শান্তি উভয় লাভ হবে। মানসিক শান্তি ও অহমিকার মধ্যে প্রথমটাকে গ্রহন করাই শ্রেয়। অপরকে ঘৃনা করলে, তার শক্তি আমরা বাড়িয়ে দিই। অশান্তির মাঝে শান্তিতে থাকার জন্য বুদ্ধের উপদেশ হলো “ ঘৃণ্য লোকের মধ্যে ঘৃনাশূণ্য হয়ে থাকতে পারলেই প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়”। না হলে ক্রোধ ও হতাশা আমাদেরকে দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত করবে।। যারা নানা ভাবে বিপদে ফেলে দুঃখ দেয়, তাদের ক্ষমা করে ভদ্র আচরন করাই যথাযত। ক্রোধ, অহংকারের বশীভূত হয়ে মানুষ এই ধরনের মনোবৃত্তির অধীন হয়ে পরে, এদের কে ক্ষমা করা সহজ নয়। তবুও বুদ্ধের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে দেখা যাবে তা অসাধ্য ও নয়। বুদ্ধের উপলব্ধি হলো “ আমার প্রতি যত অন্যায় বর্ষিত হবে ততই আমার মধ্যে থেকে সদ্ভাবনা, করুনা, মৈত্রী বিচ্ছুরিত হবে”।
স্বার্থপর হয়ে কেবল নিজের সুখের, চাহিদার কথা ভাবি, তাহলে তার মূল্য মানুষকে দিতেই হবে। অতিরিক্ত ভোগবাসনা দুঃখকে বেশী করে টেনে আনে।মানসিক অশান্তি ও অস্হিরতা থেকে মুক্ত হতে হলে স্বার্থচিন্তাকে অবদমিত করতেই হবে, না হলে কোন দিন শান্তি করায়ত্ত হবে না। জীবনে চলার পথে অনেক পথসন্ধি আসে, যার একদিকে জাগতিক সুখও যেমন আছে আবার দুঃখ দুশ্চিন্তা ও আছে, আর একদিকে আছে মুক্তি ও আধ্যাতিক উন্নতির মার্গ। নিজেকে বেছে নিতে হবে সঠিক পথ। নিজের মধ্যে যে দীপক আছে তাকে প্রজ্জলিত করতেই বুদ্ধ, অন্তিম সময়ে ভিক্ষু আনন্দকে এই উপদেশই দিয়ে গেছেন।
বুদ্ধ ৪৫ বছর ধর্ম প্রচার করেছেন, মানুষের দুঃখ মুক্তির উপায় কি ভাবে হবে দেখিয়ে গেছেন। সেই পথে চলেই আসবে আমাদের কাঙ্খিত সুখ, নির্বানের সোপান।
“ সব্ব পাপস্য আক্রনম
কুশলস্য উপসম্পদা
সচ্চিতা পরিয়োদপানম
এতম বুদ্ধ শাসনম”
অর্থাৎ সংসারে সদা অকুশল কর্ম পরিহার করে কুশল কর্ম করবে। নিজের মনকে পরিশুদ্ধ করতে হবে ধ্যান ভাবনার মধ্য দিয়ে। আর এটাই বুদ্ধের বিশ্বব্যাপী উপদেশ সকলের জন্য।
শ্রীমতী রঞ্জিতা তালুকদার
১১৯ বরোদা এভিনিউ
গগনেশ্বরী এপার্টমেন্ট
কলকাতা ৮৪