মধু পূর্ণিমা ও বুদ্ধোপদেশ – ভিক্ষু সুমনপাল

মধু পূর্ণিমা ও বুদ্ধোপদেশ – ভিক্ষু সুমনপাল
মধু পূর্ণিমা ও বুদ্ধোপদেশ
ভিক্ষু সুমনপাল

মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ সাহিত্য ও ইতিহাসে অত্যন্ত  তাৎপর্যমণ্ডিত দিন। বুদ্ধের জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মধু পূর্ণিমা অন্যতম। ত্যাগ ও ঐক্যের সুষমায় সমুজ্জল এদিনটি। বৌদ্ধরা মধু পূর্ণিমাকে অতি শ্রদ্ধার সাথে পালন করার তাৎপর্যের দুটো দিক পরিলক্ষিত হয়। প্রথমটি সেবা ও ত্যাগ, অন্যটি সৌর্হাদ্য, সম্প্রীতি ও সংহতির। ত্যাগের দিকটি হলো পারিলেয্য বনের বানর কর্তৃক বুদ্ধকে মধু দান ও হস্তিরাজ দ্বারা  সেবা প্রদান। আর সৌর্হাদ্য ও সংহতি হলো কৌশাম্বীর (বর্তমান এলাহাবাদ)  ঘোষিতারামে বিবাদমান ভিক্ষুসংঘের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা।কৌশাম্বীর ঘোষিতারামে বুদ্ধ অবস্থানকালীন সময়ে ভিক্ষুদের জীবন যাপনে বিনয়ের ছোট্ট একটা অনুষঙ্গ নিয়ে ভিক্ষুসংঘের মধ্যে সৃষ্ট হয়েছিল বিরোধ এবং বিভাজন। দ্বিধাবিভক্ত ভিক্ষুসংঘের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তথাগত বুদ্ধ মুক্তকণ্ঠে ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন–’হে ভিক্ষুগণ! বিরোধ সম্যক জীবনাচরণে অপঘাত স্বরূপ। সংঘের একতা বিনষ্ট হয়।’ তবু এ বিরোধের অবসান হয়নি।

বুদ্ধ বিবাদমান ভিক্ষুসংঘের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু বুদ্ধের ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় মান-অভিমানের কারণে আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়েন। বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের এ অবস্থা দেখে “একো চরে খগ্গবিসানো কপ্পো” একাকী থাকার নীতি গ্রহণ করলেন এবং  সিদ্ধান্ত নিলেন কৌশাম্বী ত্যাগ করে পারিলেয্য বনে অবস্থান করবেন। বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের বিবাদমান কলহের কারণে দশম বর্ষাবাস অধিষ্ঠান পারিলেয্য বনে করলেন।
পারিলেয্য বনে বুদ্ধের আগমনে বনরাজি বিচিত্র শোভাবরী, কথিত আছে পারিলেয্য বন থেকে বুদ্ধ যখন ভিক্ষান্ন সংগ্রহে বার হতেন হস্তিরাজ বুদ্ধের পাত্রটি স্বীয় শুণ্ডে বহন করে জনসাধারণের গমনাগমনের পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। পুনরায় বুদ্ধের ভিক্ষাচর্যা বা পিণ্ডাচরণ শেষ হলে ফেরার পথে পুনরায় আগুবাড়িয়ে  আনতেন। এও কথিত আছে হস্তিরাজ বুদ্ধের স্নানের জলের ব্যবস্থা করতেন এবং অন্যান্য হিংস্র জন্তুদের হাত থেকে রক্ষা নিমিত্তে সারা রাত্রি পাহারায় রত থাকতেন। বন থেকে নানা রকম ফলমূল সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করতেন। ঠিক অনুরূপভাবে বানরও স্বকীয় দল ত্যাগ করে বুদ্ধের সেবায় রত হলেন।
তখন উপাসক উপাসিকাগণ কৌশাম্বীর ঘোষিতারামে গিয়ে দেখলেন বুদ্ধ বিহারে নেই এবং  উপাসক উপাসিকা সকলে জানতে চাইলেন বুদ্ধ কোথায়?  বিবাদমান ভিক্ষুগণ নিরুত্তাপ। ভিক্ষুসংঘের নিরবতা পরিলক্ষিত করে উপাসক উপাসিকারা সন্ধান পেলেন যে, ভিক্ষুসংঘের বিরোধ ও বিবাদের কারণে বুদ্ধ ঘোষিতারাম ছেড়ে পারিলেয্য বনে অবস্থান করছেন। ভিক্ষুসংঘের অবিদ্যা ও অহমিকা দেখে বুদ্ধ একাকী চলার নীতি গ্রহণ করেছেন। উপাসক উপাসিকারা ভিক্ষুসংঘের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, যদি বুদ্ধ কৌশাম্বীতে ফিরে না আসেন তাহলে সংঘ সান্নিধ্য পরিত্যাগ করবেন। উপাসক উপাসিকাদের কারণে ভিক্ষুসংঘের মধ্যে সম্যক চেতনার উন্মেষ হলো এবং তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন এবং তাঁদের মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি হলো। উপাসক উপাসিকাদের আহ্বানে বিবাদমান ভিক্ষুসংঘ সমস্ত বিভেদ বিসংবাদ ভুলে পারিলেয্য বনে উপনিত হলেন বুদ্ধকে ফিরিয়ে আনতে। ভিক্ষুসংঘ বললেন–’ভন্তে, আমরা সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এবং ভুলত্রুটি অপনোদন করে অন্ধবিবর থেকে আলোর সম্পাতে উত্তরণ ঘটিয়েছি। সমস্ত ভুলত্রুটি সংশোধন করে  সংঘের মধ্যে পুনরায় ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করেছি পুনরায় মৈত্রী বারিতে অবগাহন করেছি। ভন্তে এবার প্রত্যাবর্তন করুন কৌশাম্বীর ঘোষিতারামে।’
বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের ঐক্য ও সংহতি দেখে বর্ষাবাসান্তে পারিলেয্য বন ছেড়ে কৌশাম্বীর ঘোষিতারামে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বুদ্ধ সেই সময় ভিক্ষুসংঘকে উপদেশোক্তি করলেন–’মূর্খেরা জানে না তাদের কখন মৃত্যু হবে, যখন তা জানতে পারে, তখন সকল কলহের অবসান ঘটে।’
পারিলেয্য বনে বুদ্ধ অবস্থানের সময় ভাদ্র পূর্ণিমা তিথিতে গভীর অরণ্য থেকে বানর একটি মধুমক্ষিকা সহ মৌচাক সংগ্রহ করে শ্রদ্ধাপ্লুত চিত্তে বুদ্ধকে দান করেন। পারিলেয্য বনে বুদ্ধকে হস্তিরাজ কর্তৃক সেবা ও বানরের মধু দান বৌদ্ধ সাহিত্য তথা  ইতিহাসে এক গুরুত্ববহ ঘটনা। এই পূর্ণিমার দিন উপাসক উপাসিকারা বিহারে এসে বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে মধু ও নানা রকম ভৈষজ্য ঔষধাদি দানাদি কর্ম করে থাকেন।
ইতিমধ্যে কৌশাম্বী থেকে মহতি ভিক্ষুসংঘ ও বুদ্ধ সেবক আনন্দ বুদ্ধ দর্শনে পারিলেয্য বনে গেলেন এবং বনে বুদ্ধকে একা দেখে আনন্দ মর্মাহত হলেন। দুঃখ সন্তাপগ্রস্ত আনন্দকে বুদ্ধ উপদেশোক্তি করলেন—’যদি তুমি জ্ঞানী, সদাচারী, পণ্ডিত ও ধীর ব্যক্তিকে মিত্র রূপে লাভ কর, তাহলে সকল বাঁধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সানন্দে তাঁর অনুগমন করবে। আর যদি তুমি জ্ঞানী, সদাচারী ও পণ্ডিত বা ধীর ব্যক্তিকে মিত্র রূপে না পাও , তাহলে বিজিত রাষ্ট্রত্যাগী রাজা অথবা গণ্ডারের ন্যায় একাকী বিচরণ করবে, কখনও পাপাচারণের বশবর্তী হবে না।”
মানুষের বেশীর ভাগ অশান্তির মূল হল অহংকার। অহংকার থেকেই কেবল মনে করে পৃথিবীতে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এই মিথ্যা অহমিকা থেকে কলহ, বিবাদ, ঝঞ্ঝাট ইত্যাদি। বুদ্ধ পারিলেয্য বনে একাকী চলার নীতি গ্রহণ করে বিবাদমান অজ্ঞতাপূর্ণ, মোহাচ্ছন্ন ভিক্ষুদের শিক্ষা দিয়েছিলেন।
বুদ্ধকে বনের হস্তিরাজ কর্তৃক সেবা ও বানরের মধু দান ছিল তাঁদের একান্ত শ্রদ্ধা ও ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ। তীর্যক প্রাণীর ত্যাগ ও সেবার কারনে বুদ্ধ একাকী পারিলেয্য বনে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে বলা চলে। ফলস্বরূপ বিবাদমান ভিক্ষুসংঘের মধ্যে অনৈক্য ও কলহের অবসান ঘটে, সাম্য- মৈত্রীর উষ্ণ প্রস্রবণ বাহিত হয় এবং নিরঞ্জন ফল্গুধারায় স্নাত হয় আসমুদ্র হিমাচল।

বি: দ্র: এখানে প্রশ্ন আসতে পারে সবার মধ্যে, তীর্যক প্রাণী কি করে সেবা করতে বা বুঝতে পারে, একটা কথা আমাদের স্মরণে থাকা উচিত সেটা হলো সিদ্ধার্থ বুদ্ধ ছিলেন রাজপুত্র (ছোট গণরাজ্যের প্রধানকেও রাজা বলা হতো) সেই কারণে তাঁকে সমস্ত শিল্প শিক্ষায় পারদর্শীতা অর্জন করতে হয়েছিল এবং সেই সুবাদে তিনি Animal Psychology বিদ্যাও লাভ করেছিলেন। সেই কারণে বনে প্রকৃতি এবং বন্য প্রাণীদের সঙ্গে অবাধ বিচরণ সম্ভব হয়েছিল। আর বাদ বিসংবাদ নিরসন ও সাম্য মৈত্রী এসব কিছুই বুদ্ধ সিদ্ধার্থ শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে তরুণ, তরুণ থেকে যৌবনে পদার্পণ করতে করতেই আপন বুদ্ধিমত্তা তথা আচার্যদের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সে সবের সম্যক ধারণা বা ইতিহাস তাঁর জীবনী থেকেই উপলব্ধ হয়। এবং এটিও অকপটে বলা যায় যে, বুদ্ধ প্রকৃতি আর প্রাণী কুলের কত কাছাকাছি অবস্থান করতে ভালোবাসতেন।এক কথায় সর্বজীবের মৈত্রী করুণা শিশুকাল থেকেই তাঁর মানসে রেখাপাত হয়েছিল। এখানে অত্যুক্তি না করাই বাঞ্চনীয় বলে মনে করি।

 বুদ্ধের দৃষ্টিতে প্রজা পালন
ভিক্ষু সুমনপাল

বুদ্ধ গণপ্রজাতন্ত্র শাক্যরাজ্যে যাওয়ার পর শাক্য রাজাদের আন্তরিক আহ্বানে শাক্য সন্হাগারে (সংসদে) উপস্থিত হয়ে কিভাবে সত্যিকার অর্থে সদুপায়ে প্রজাতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা  করতে হয় তার উপায় নির্দেশ করেছেন। তারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন- “রাষ্ট্র পরিচালনায় কিংবা  রাজনীতিতে কিংবা প্রজা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আপনার দেশিত মার্গ কিভাবে অনুসরণ করব।” বুদ্ধ প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন- ”শাসন না করে” ।
তারা বললেন- সবিস্তারে ব্যাখ্যা করুন।
প্রথমত আপনাদের মধ্যে যে ধ্যান ধারণা আছে আমরা শাসন করবো তা আপনাদের অন্তর থেকে ত্যাগ বা নির্মূল করতে হবে। ত্যাগ করতে হবে আপনার শাসকের দাম্বিকতা ধ্যান ধারণা। দ্বিতীয়ত হলো আপনার অন্তরে জাগাতে হবে, তা হলো মৈত্রী, পিতৃ কর্তব্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। কর্মচক্রে আপনি রাজা হন বা রাজা হয়েছেন তাহলে আপনি প্রজাদের অশ্রুপাত মোছিয়ে তাদের দুঃখ দূর করতে পারেন।
এই কৃত কর্তব্য আপনি-আপনারা নিজ নিজ গৃহে সম্পাদন করছেন প্রতিনিয়ত যেমন করে থাকেন একজন পিতা, তাহ‌লে শাসক হয়ে কেন প্রজাদের প্রতি পিতৃ কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন না। কারণ আপনারা নিজেদের প্রজা থেকে ভিন্ন বা উচ্চ মনে করে থাকেন।
আর এই জন্যেই আপনারা জিজ্ঞাসা করছেন জাগ্রত এবং  ন্যায়োচিত শাসক কি করে হতে হয় বা হওয়া উচিত। কিন্তু এই প্রশ্ন আপনারা জিজ্ঞাসা করেন না যে,  যখন আপনারা পিতা হয়েছেন বা পিতা হন। আমাদের বা আপনাকে পিতার কর্তব্য কেমন হতে হবে তা সবাই জানেন কারণ ওখানে আত্মভাব সদা বিদ্যমান। সন্তানের প্রতি পিতার কর্তব্য জানেন কিন্তু শাসক হয়ে প্রজার প্রতি কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পাদন করতে জানেন না, তাহ‌লে পিতার ন্যায় এই আন্তরিক ভাবকে আর একটু প্রসারিত করুন, এই প্রজা আপনার সন্তান তুল্য, সবাই আপনার আপনজন সকলের দুঃখ নিজের দুঃখ ভেবে সেভাবে শাসন করুন। সবাইকে ন্যায়, সুখ ও আনন্দ দেওয়ার যে মার্গ বা ক্ষমতা আপনাদের মধ্যে প্রাপ্ত হয়েছে তা শুধু মাত্র শাসক হিসেবে থে‌কে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে দেবেন না। শারীরিক ও মানসিক রোগে সমস্ত মানব পীড়িত, দুঃখ দুর্দশায় জর্জরিত। কিন্তু তাদের আপনি-আপনারা সামাজিক অর্থনৈতিক ন্যায় দিয়ে তাদের মানব জীবনকে সুখময় করে দিতে পারেন।
তৎক্ষণাৎ শাক্য গণরাজ্যের রাজারা বুদ্ধকে শাক্যদের রাজা হতে অনুরোধ করেন। বুদ্ধ তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন আমাকে শাক্য রাজ্যে গণ্ডিতে আবদ্ধ না থে‌কে ধরিত্রীর মানবতাকে জাগাতে হবে যাতে সকলে মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে।

About The Author

Tridib

An Education and Religious Book Publisher based in Delhi (India) associated with prominent Buddhist organisations and temple associations, including Mahabodhi Mahavihara Temple, Bodh Gaya (Bihar) India. Created this website "baruasamaj.com" in the year 2010-11 with a view to bring the members of Barua community to a common platform, and to make available all relevant information about the community.

Leave a reply

Your email address will not be published.

Follow Us

Recent Videos

Loading...